শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ১০:০৯ অপরাহ্ন
মোস্তফা কামাল:
হোক অস্থির, আনপ্রেডিকটেবল কান্ট্রি। আগামীকাল পর্যন্ত দেশটিতে কী হবে তার ঠিকঠিকানা নেই। তারপরও নির্বাচনে ইমরান ধামাকা হয়ে গেল পাকিস্তানে। বলা হয়ে থাকে স্থানিক রাজনীতি, কূটনীতি, অর্থনীতিসহ অনেক ক্ষেত্রেই দেশটি ধ্বংসের শেষ সীমায়। এর মাঝেই সেনা, মার্কিন মিলিয়ে আরও অনেকের মুখে চপেটাঘাত ফেলেছে নির্বাচনটি। ক্রিকেট মহারাজ ইমরান খান ও তার দলের নেতারা কারাবন্দি, নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণাসহ কত বাধা সয়েও ডামি-স্বতন্ত্রসহ নানা তন্ত্র-মন্ত্রে শক্তি দেখানোর মতো রেকর্ড তৈরি করেছেন বিরোধীরা। কপালে ভাঁজ উঠে গেছে পশ্চিমা বিশে^র। পাকিস্তানের নির্বাচন, যারপরনাই মনোযোগ পেয়েছে পশ্চিমা মিডিয়ায়। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট বন্ধের ব্যাপারটাকে বিতর্কিত পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে তারা। প্রায় প্রতিটি রিপোর্টেরই অধিকাংশ জুড়ে ছিল ইমরান খান। তার দল পাকিস্তান তেহরিক ই ইনসাফ পিটিআইর ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সংবাদ সম্মেলনে জানালেন, দলের আরও অন্তত ৫০ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতেছে। কিন্তু দেশের নির্বাচন কমিশন তাদের বিজয়ী ঘোষণা করেনি। তারা ‘ডকুমেন্টস’ দিয়ে হাইকোর্টে মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন। সেটা পরের বিষয়। প্রায় দেশেই ইলেকশন ট্রাইব্যুনালের মামলার রায় হতে হতে আরেকটি নির্বাচন এসে যায়। প্রশ্ন ভিন্ন জায়গায়। ক্ষমতাসীনদের এত নিয়ন্ত্রণের মাঝেও পাকিস্তানে এমনটি হলো কেন? নির্বাচনের আগে কারাদ- দিয়ে ইমরান খানকে আটকে দেওয়া হয়। জেলে নেওয়া হয়। নির্বাচন করতে দেওয়া হয়নি। মূল ধারার গণমাধ্যম তাকে তেমন ফেভার করেনি। তা মোকাবিলার চেষ্টা হয় সোশ্যাল মিডিয়া আর পার্সোনাল কানেকশনে। ইমরানের দলের নির্বাচনী প্রতীক ক্রিকেট ব্যাটও কেড়ে নেওয়া হয়। এতে তার প্রার্থীরা কেবল দলীয় নয়, মার্কা সংকটেও পড়ে যান। বেলুন, বেগুন, জুতা ইত্যাদি হাস্যকর মার্কায় নির্বাচন করেন। সেখানেও চিকন মারে ছক্কা হাঁকিয়ে দেন তারা। ফলাফল ঘোষণার ধীরগতিতেও দলটির কর্মী-সমর্থকরা মাঠ ছাড়েনি। তাহলে কী ঘটেছিল ভেতরে, ভেতরে?
একপর্যায়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মধ্যরাতে বাড়ি চলে যান। কিছুক্ষণ ফলাফল ঘোষণা বন্ধ থাকে। এতে কিছুটা বাংলাদেশের এবারের নির্বাচনী ফলাফলে রাতের মিল। এ ছাড়া বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের পর পাকিস্তানেও ‘স্বতন্ত্র চমক’ আরেকটি মিল। পাকিস্তানে ভোটের পরদিন ৯ ফেব্রুয়ারি দুপুরের পর থেকে আবার থেমে থেমে ফল ঘোষণা শুরু হয়। সেখানেও থাকে অস্বচ্ছতা। পিটিআই কর্মীরা প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে। ‘মানি না, মানি না’ বলে মাঠ ছেড়ে চলে যায়নি। তাদের স্বতন্ত্রের ডামিতেই চিত্র পাল্টে গেছে। তার মানে পাকিস্তান গণতন্ত্রে চলে এসেছে?
পাকিস্তানের রাজনীতি ও নির্বাচনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা বরাবরই সমালোচিত। এটি তাদের সংস্কৃতির মতো। ক্ষমতায় যেতে, টিকে থাকতে সেনাবাহিনীর পরশে ধন্য হওয়ার ইতিহাস রয়েছে ইমরান খানেরও। আবার ক্ষমতাচ্যুতও হয়েছেন সেনাবাহিনীর ছোঁয়া ধরে রাখতে না পারায়। দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনিরের সামনে এখন পথ দুটি। হয় ইমরান খানের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে ফেলা, নইলে ইমরানবিরোধীদের এক জোটে নিয়ে আসা। পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা ১৯৮৮ সালের মতো। তখন সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিরোধিতা মোকাবিলা করে নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন বেনজির ভুট্টো। মার্কিন চাপে অনিচ্ছায় বেনজির ভুট্টোকে সরকার গঠন করতে দেয় সেনাবাহিনী। কিন্তু মেয়াদ শেষ করতে দেয়নি। ১৯৯০ সালে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে তার সরকারকে উৎখাতের পেছনে কলকাঠি নেড়েছিল সেনাবাহিনী। ইমরানের সঙ্গেও তা করেছে।
এবারের অন্যতম কড়া অভিযোগ প্রধান প্রধান শহরগুলোতে; বিশেষত সেনাসদরের আশপাশের আসনগুলোতে ফল উল্টে দেওয়া হয়েছে। এমনকি নওয়াজ শরিফ একটি আসনে হেরে গেলে, আরেকটি আসনে তাকে জোর করে জেতানো হয়েছে; মনগড়া ফলাফলে ভোটারের সংখ্যা তালিকার চেয়ে বেশি এসেছে; এ রকম অভিযোগ নিয়ে নির্বাচন কমিশনে হাজির হয়েছেন পিটিআই নেতারা। নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু ভোটগ্রহণ ও সুষ্ঠু ফলাফল দেওয়ার পেশাদার ইচ্ছা ছিল বলে মনে হয়। এমনকি সিভিল প্রশাসনের রিটার্নিং অফিসাররাও অনেক জায়গায় সেনাবাহিনীর চাপের কাছে নতি স্বীকার করেননি। জনগণকে ভোট বিদ্রোহ করতে দেখে অনেকেই সেনাবাহিনী কিংবা নওয়াজের ‘সহমত ভাই’ হতে চাননি।
এদিকে পাকিস্তানের পার্লামেন্ট নির্বাচনে অনিয়ম-অস্বচ্ছতার অভিযোগে উদ্বেগ জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ বিষয়ে তদন্তের আহ্বানও জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ উভয়ই হস্তক্ষেপের অভিযোগের কথা উল্লেখ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে কর্মীদের গ্রেপ্তার, নির্বাচনে অনিয়ম, হস্তক্ষেপ এবং ভোট জালিয়াতির দাবিগুলো যার সম্পূর্ণ তদন্ত করা উচিত। ইইউ বিবৃতিতে ‘একটি সমতল খেলার মাঠের অভাব’ উল্লেখ করে বলেছে, ‘কিছু রাজনৈতিক নেতার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা’ এবং সমাবেশের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং ইন্টারনেট অ্যাক্সেসের সীমাবদ্ধতাকে দায়ী করা হয়েছে। গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর সহিংসতা এবং হামলার কথা উল্লেখ করে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলেছে যে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সমাবেশে ‘অযাচিত বিধিনিষেধ’ ছিল।
অন্যদিকে পাকিস্তানের ‘দ্য ডনের’ খবর বলছে, ইমরানের দল এখন আর তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে মার্কিন প্রশাসনকে দায়ী করছে না। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের খবরও এমনই। এটিই পাকিস্তানের রাজনীতি এবং রাজনীতিকদের বরাবরের স্বভাব-বৈশিষ্ট্য। সেই বিবেচনায় পাকিস্তানে ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে নানা চমকের একটি মাত্র বলা যায়। তা মোটেই শেষ চমক নয়। এতে খুব অবাক-হতবাক হওয়ার কিছু নেই। মাঝেমধ্যে টুকটাক কথা হলেও দেশটির সেনাবাহিনী সময়ের ব্যবধানে একই কাজ করে। দল এবং নেতারাও একই অনুসারী। নিজে আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত তারা বলেন না এই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। পরে আবার নিজেই শামিল হন সেসনা কানেকশনে। ১৯৭০ সালে জনগণের এভাবে ভোটকেন্দ্রে এসে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে গণকণ্ঠস্বর উদ্দীপিত করার বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেসময়ের পূর্ব পাকিস্তানে নিজেদের জন্য কবর খুঁড়েছিল। সেই কবর থেকে তারা ওঠে না। কখনো কখনো উঠলেও আবার কোনো কোনো কবরেই জায়গা নেয়। এই অভ্যস্ততার মাঝে তারা এবার কোনো হোঁচট খেল কিনা তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যায় না। সে ক্ষেত্রে সামনের কিছুদিন অপেক্ষা করতেই হয়।
এবার পাকিস্তানে ইসলামপন্থি দলগুলোর ভরাডুবিও একটি মোটা দাগের ঘটনা। আসন সংখ্যায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ দ্বিতীয়, বিলাওয়াল ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি-পিপিপির তৃতীয় স্থানে বিপরীতে ইসলামপন্থিদের কোনো অবস্থানই নেই। ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় ইসলামপন্থি দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম প্রধান মাওলানা ফজলুর রেহমান পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীর কাছে হেরেছেন। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামীর প্রধান সিরাজুল হকও হেরেছেন পিটিআই সমর্থিত আরেক প্রার্থীর কাছে। এর আগে, ২০১৮ সালে যেখানে মাত্র ১২টি ধর্মপন্থি দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। সে তুলনায় এবার ২৩টি দল নির্বাচনে অংশ নেয়। এবার ভোটের ফলাফলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা অবনতির চিত্র আরও স্পষ্ট। ২০১৩ সালের পর থেকে দেশটিতে ধীরে ধীরে ইসলামপন্থি দলগুলোর ভোটার কমেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এবার ইসলামপন্থিদের গ্রহণযোগ্যতা হারানোর পেছনে ৫ কোটি ৬৮ লাখ তরুণ ভোটারের ভূমিকা রয়েছে, যা মোট ভোটারের ৪৫ শতাংশ।
প্রতিবেশী ভারত যেখানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দিকে ঝুঁকছে, সেখানে পাকিস্তানের জনগণ এ ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে । পাকিস্তানের পর এখন স্বাভাবিকভাবেই ভারতের দিকে দৃষ্টি। এপ্রিল-মে মাসে হতে যাওয়া নির্বাচনের আগেই কারচুপির প্রস্তুতির অভিযোগ উঠে গেছে ভারতে। বিপুল জয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের দৃঢ় আশা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। সরকারের মেয়াদ পূর্তি ও লোকসভা নির্বাচনের আগে বাজেট অধিবেশনে পার্লামেন্টে শেষ ভাষণে এ আশাবাদের কথা জানান। সেই সঙ্গে বিরোধী দল কংগ্রেসে পরিবারতন্ত্রের সমালোচনা করেন নরেন্দ্র মোদি। কটাক্ষ করেন অধিবেশনে থাকা কংগ্রেস নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরীকে নিয়ে। দৃঢ় আত্মবিশ্বাসী মোদির দাবি, লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে কমপক্ষে ৪০০টিতে জিতবে বিজেপি নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোট এনডিএ। এতে শুধু বিজেপির পক্ষেই যাবে ৩৭০টি আসন। মোদির এই আত্মবিশ্বাসে ষড়যন্ত্রের সন্দেহ জানান কংগ্রেস নেতা অধীর। বলেন, অহঙ্কারের উত্তাপে জনগণ কাকে ভোট দেবে সেই পরোয়া করছেন না মোদি। অধীরের দাবি, ইভিএমে কারসাজির প্রস্তুতি না থাকলে এতগুলো আসনে জয়ের বিষয়ে এতটা নিশ্চিত থাকা অসম্ভব। মোদির ভাষণের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীর সমালোচানায় কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন রাহুল গান্ধী, মল্লিকার্জুন খড়গেসহ কংগ্রেস শীর্ষ নেতারা। সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয়েছে ‘হ্যাশট্যাগ বাই বাই মোদি’ আন্দোলন।
৭ জানুয়ারি ১৭ কোটি জনগণের বাংলাদেশের নির্বাচনের এক মাস পর ৮ ফেব্রুয়ারি হলো ২৪ কোটি মানুষের পাকিস্তানের নির্বাচন। এরপর রয়েছে আরেক জনবহুল মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ার নির্বাচন। বাংলাদেশের জন্য শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তান আর বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্ববহ। গোটা বিশ্বে নির্বাচনের ভালো-মন্দ তালিম দেওয়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচনও এ বছরই।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
mostofa71@gmail.com
ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশরূপান্তর